সোমবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:৩৬ অপরাহ্ন

শেষের কথা

মাসুদ করিম
  • আপডেটের সময় : সোমবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০২১
  • ১২২০ বার দর্শন

বেঁচে থাকলে আজ তাঁর বয়স হতো ছিয়াশি: অদ্বিতীয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিনে অসীম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।

আমি জানতাম না একথাই হবে শেষ কথা। যদি তাই হতো তবে কথা বলতাম লাইন না কাটা অবধি। গত বছর ২৯ জুন সকাল ১১টায় ফোন করি কলকাতায়। ১০০ সেকেন্ড কথা হয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সাথে। বলার চেষ্টা করি সময়টি মোটেই ভাল নয়। এ মূহূর্তে সুস্থ থাকাটা খুব জরুরী। সৌমিত্রদা যাতে স্যুটিং এ না যান। বার বার বললাম। যদিও বয়সে যারা ছোট তাদের কথা বড়রা খুব একটা আমলে নিতে চান না। মনে করা হয় এসব কথার কথা।

আগস্টে কলকাতার একটি বাংলা পত্রিকায় সৌমিত্রদার সাক্ষাৎকারভিত্তিক সংবাদ ছাপা হয়। সংবাদটি দেখে আমি অনেকটা আতংকিত হয়ে পড়ি। আমার ধারনা ভয় কে জয় করে নয়, বরং সৌমিত্রদাকে অনেকটা জোর করেই স্যুটিং এ নামানো হয় প্রযোজকদের চাহিদার কারণে। পরিচালক পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় এর নেপথ্যে কাজ করেছেন।  

১৯৫৮-র ৯ আগস্ট, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে একটি স্মরণীয়দিন, সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে সৌমিত্র এদিন প্রথম ক্যামেরার মুখোমুখি হলেন। তাঁর প্রথম ছবি, সত্যজিৎ রায়ের পঞ্চম। তারপর এই দুই দীর্ঘাদেহী পুরুষ, সত্যজিৎ ও সৌমিত্র, দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে বাংলা চলচ্চিত্রকে নান্দনিক সাফল্যের এক চূড়া থেকে আরেক চূড়ায় নিয়ে গেছেন। সত্যজিৎ রায়ের চৌদ্দটি ছবির নায়ক ছিলেন সৌমিত্র। আমার প্রতিটি ছবির স্ক্রিপ্ট আমি সৌমিত্রকে দেখাতাম। তাই একদা এক অনুষ্ঠানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে কিছু বলতে গিয়ে সত্যজিৎ রায় বলেন, ওর প্রতি আমার নির্ভরশীলতা শিল্পী জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত থাকবে”। 

সত্যজিৎ রায়ের চারুলতা ছবির একটি দৃশ্য এখনও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনে স্মৃতির মাঝে অন্যতম হয়ে আছে। ছবির শেষ দৃশ্যটি সত্যজিৎ এমনভাবে সাজিয়ে ছিলেন যে, চারু ও ধ্রুপদী একে অন্যের হাত ধরে ঘরের ভেতর প্রবেশ করে। কিন্তু এই দৃশ্যটি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে একদম পসন্দ হয়নি। তাই আমি মানিকদাকে (সত্যজিৎ রায় এর ডাকনাম) বললাম,“এই দৃশ্যটি আমার একদম পসন্দ হয়নি। কেননা ধ্রুপদীর যখন বোধদয় হলো যে তার স্ত্রীর সঙ্গে অমলের একটা সম্পর্ক গড়ে উঠে, তারপরতো সে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায় এবং এক পর্যায়ে আবার ফিরেও আসে। কিন্তু যখন ফিরে আসে তখন চারু তাকে ডাকলো ঘরে প্রবেশ করার জন্য। সেখানে খুব ছোট দু’তিনটি সংলাপ ছিল। চারু তাকে বললো, এসো, ঘরে এসো। তখন ধ্রুপদী তাকে বলেছিল, এ ঘর কি আর সে ঘর আছে? তখন হাতটা বাড়িয়ে ঘরে চলে যায়”।

কিন্তু  এদৃশ্য আমার একদম পসন্দ হয়নি। কেননা বরীন্দ্রনাথের চারু বললো, না থাক। সেটা এমন  মর্মান্তিক যেন বুকে একটা শেল বিধিয়ে দেয়, যেন দুঃখ-বেদনা-যন্ত্রণার এক বহিঃপ্রকাশ। আমি মানিকদাকে বললাম, “এদৃশ্য আমার একদম পসন্দ হয়নি। মানিকদা বললেন, কেন?এছাড়া আর কি হতে পারতো? কারণ তখনতো ডিভোর্স ছিল না, তাদেরতো একসাথে বাস করতে হতো”।

আমি বললাম, হ্যাঁ, সেটা হয়তো লোজিক্যালী ঠিক কিন্তু আরো অন্যকিছু লোজিকও বোধহয় আছে। আমার এদৃশ্যটি ভাল লাগছে না। এরপর সেদিন আমি কাজ শেষে বাড়ি চলে যাই।

পরদিন সকালে যখন স্যুটিং এ এলাম তখন শিশুর মত উৎসাহ নিয়ে মানিকদা আমাকে বললেন, শোন, কাল রাতে আমি ওটা পাল্টিয়েছি।

আমি জানতে চাইলাম, কি করেছেন মানিকদা?

তখন তিনি নতুন এন্ডিংটা আমাকে শোনালেন। বললেন, হাত দু’টো এগিয়ে আসছে- একে অন্যের দিকে, চারদিকে সবকিছু পাথরের মত স্তব্ধ, পৃথিবীতে আর কিছুই নড়ছেনা। এমনকি বাড়ির চাকরটা বাতি নিয়ে আসছে। নিরবতা গভীর হচ্ছে। এই যে দূরত্ব, আর কোনদিন সে স্পর্শ করছে না।

এই চির দূরত্বটাকে বিদ্যমান কাঠামোতে ফুটিয়ে তোলার কারণেই `চারুলতা’ দর্শক হৃদয়ে স্থায়ীভাবে দাগ কেটেছে।

– সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এর জীবন ও কর্মভিত্তিক তথ্যচিত্র `কৃষ্ণকলি`র চুম্বক অংশ, ২৫ জুলাই, ২০১৪, কলেজ স্ট্রীট, কলকাতা।

“এটা সত্য যে, আজকের সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে সত্যজিৎ রায় গড়ে তুলেছেন। আবার এটাও সত্য যে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও সত্যজিৎ রায়কে প্রকাশিত হতে সাহায্য করেছেন, তাই একমাত্র সত্যজিৎ রায় এর জন্যই সৌমিত্র এতটুকু পথ পাড়ি দিতে পেরেছেন তা তারাই বলেন যারা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে পুরোপুরি জানার চেষ্টা করেননি”।

– মাসুদ করিম 

চলচ্চিত্রকার 

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এর জীবন ও কর্মভিত্তিক তথ্যচিত্র `কৃষ্ণকলি`র নির্মাতা।

দৈনিক কালের কন্ঠ, ২০ জুন, ২০১৫ ।

এই পোস্টটি আপনার সামাজিক মিডিয়াতে শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও খবর

Address

Registered Office: 44/1 North Dhanmondi (5th Floor) Kalabagan, Dhaka- 1205, Bangladesh Email: kalabaganbarta@gmail.com / admin@kalabaganbarta.com Telephone: +88-02-58154100 Editorial Office: Karim Tower 44/7-A&B, West Panthapath, Kalabagan, Dhaka-1205

Correspondences

USA: Mainul Haq (Atlanta) Kolkata: Sunirmal Chakraborty Mobile: +91-8017854521 Ashim Kumar Ghosh Address: 3D K.P Roy Lane, Tollygunge Phari Kolkata- 700 033, WB, India Mobile: +91-9874891187                                                                                                           S. M. Ashikur Rahman (Technical Adviser)
Author: Masud Karim © All rights reserved 2020. Kalabaganbarta

Design & Developed By: RTD IT ZONE