মাতৃভাষা বাংলাকে মর্যাদার সাথে টিকিয়ে রাখার জন্য ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কল্যাণীতে গঠিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বাংলা ভাষা পরিষদ। গত ২৬ নভেম্বর কল্যাণীতে ভাষা ভবনে এক উৎসবমুখর পরিবেশে শতাধিক ভাষাপ্রেমীদের উপস্হিতিতে এই সংগঠনের নবযাত্রা শুরু হয়।
সকাল থেকেই কল্যাণী ছাড়াও বিভিন্ন স্হান থেকে ভাষাপ্রেমীদের সমাগম হতে থাকে। একে একে বাংলাদেশ, কলকাতা, হুগলী, বর্ধমান, রিষড়া, আসানসোল, বারাকপুর, বৈঁচি কুলটি (পশ্চিম বর্ধমান), কৃষ্ণনগরসহ বিভিন্ন বিভিন্ন স্হানের ভাষাপ্রেমীদের সমাগম হতে থাকে। কেউ কেউ আগেরদিন রাতেই কল্যাণীতে আয়োজকদের ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন হোটেল, অতিথিশালায় অবস্থান করেন।
আয়োজকদের প্রধান পরিমল মন্ডল জরুরী কাজে কল্যাণীর বাইরে থাকলেও তিনি সকল প্রকার আয়োজন সঠিকভাবে সম্পন্ন রেখে যান। ভাষা ভবনের সকল সদস্যগন এই অনুষ্ঠানকে উপলক্ষ করে প্রায় দুই সপ্তাহ থেকেই প্রস্ততি নিতে থাকেন। এত অল্প সময়ে এই বিশাল আয়োজনের নেপথ্যে সবাই নিরলসভাবে কাজ করেছেন।
গত ২৬ নভেম্বর সকাল ৯টায় পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট বাংলাদেশ দল কল্যাণী স্টেশনে পৌঁছানোর পর সামিমুল ইসলাম তাদের অভ্যর্থনা জানান।
সকাল ১০টায় ভাষা ভবনে পৌঁছানোর পর বাংলাদেশের সদস্যদের ফুল দিয়ে বরণ করা হয়। এরপর একে একে বিভিন্ন জেলার অংশগ্রণকারীগণ ভাষা ভবনে প্রবেশ করার পর সবাইকে কড়তালির মাধ্যমে অভিনন্দন জানানো হয়।
সকাল ১০:৩০ এ উদ্বোধনী সঙ্গীত দিয়ে শুরু অনুষ্ঠান। এতে অংশ নেন তনুকা নন্দী, শম্পা চক্রর্বতী, সুজাতা মিত্র, শীলা সাহা, ড. সীমা রায়, বাণী চৌধুরী, জয়শ্রী টিকাদার, মৌসুমী বসু, সৌমিতা মুখার্জী এবং টিঙ্কু চট্টোপাধ্যায়। সঞ্চালনায় ছিলেন বাণী চৌধুরী, ড: সীমা রায় এবং জয়শ্রী টিকাদার।
নতুন সংগঠনের আত্মপ্রকাশের প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করেন শ্রীকৃষ্ণ ঘোষ । এই আলোচনা পর্বের পুরো সময়টি তিনি সঞ্চালনার দায়িত্ব পালন করেন। নতুন সংগঠন আত্মপ্রকাশ কেন জরুরী এবং কোন প্রেক্ষাপটে এই সংগঠনের যাত্রা শুরু হবে তা নিয়ে আলোকপাত করেন প্রধান সম্বনয়কারী কলকাতার ড. জয়ন্ত দাশ গুপ্ত এবং অনুপ বন্দ্যোপাধ্যায়।
সকালের প্রথম পর্বে নতুন সংগঠনের নামকরণ নিয়ে উপস্থিত সদস্যদের মাঝে বিস্তর আলোচনা হয়। তাদের কেউ কেউ ভাষা নিয়ে বিভিন্ন সংগঠনের স্বৈরাচারী মনোভাব, স্বচ্ছতার অভাব, সঠিক পরিকল্পনা না থাকা ইত্যাদি নানান অনিয়ম তুলে ধরেন। উপস্থিত আমন্ত্রিত অতিথি এবং কল্যাণীর পরিমল চন্দ্র মন্ডলসহ (ফোনে) ভাষা ভবনের বিভিন্ন ভাষাপ্রেমীদের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে একপর্যায়ে ড. জয়ন্ত দাশ গুপ্ত ‘আন্তর্জাতিক বাংলা ভাষা পরিষদ ` নাম প্রস্তাব করলে সবাই তা সমর্থন করেন।
আন্তর্জাতিক বাংলা ভাষা পরিষদ এর গঠনতন্ত্রের প্রাথমিক ধাপগুলো নিয়ে আলোচনায় সবাই অংশ নেন। ড. জয়ন্ত দাশ গুপ্ত এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন। নতুন সংগঠনের আপাতত প্রধান কার্যালয় কল্যাণীর ভাষা ভবনেই থাকছে। বাংলাদেশসহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত ভাষাপ্রেমীগন এব্যাপারে একমত হন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন মাসুদ করিম, নাসির আহমেদ, জাকির হোসেন খান। উপস্থিত সকল ভাষাপ্রেমীগন বাংলা ভাষার মানমর্যাদা রক্ষার জন্য পশ্চিমবঙ্গ থেকেই কাজ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। আর এই কাজে বাংলাদেশকে পাশে রেখে কাজ করার প্রত্যয় জানান সবাই। কেননা পৃথিবীর একমাত্র বাংলা ভাষার রাষ্ট্র হলো বাংলাদেশ।
নতুন সংগঠনের রুপরেখা কি হবে তার জন্য শ্রীকৃষ্ণ ঘোষকে প্রধান করে একটি আহবায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এই আহবায়ক কমিটি সংগঠনের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন পর্যন্ত কাজ করে যাবে। সকালের পর্বের পুরোটা সময় সভাপতিত্ব করেন জালালউদ্দিন আহমেদ।
প্রথম পর্বের অনুষ্ঠান শেষে মধ্যাহ্নভোজে শতাধিক অতিথিদের আপ্যায়িত করা হয়।
বিকেলের অধিবেশনে ধ্রুপদী ভাষা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন ড. জয়ন্ত দাশ গুপ্ত। তিনি এই ভাষার দাবী কেন প্রয়োজন এবং দাবী আদায়ের জন্য কোন কোন ধাপে কাজ করতে হবে তা নিয়ে আলোকপাত করেন। এই আলোচনায় সবাই অংশ নেন। আর এই সময়েই নতুন সংগঠনের ব্যানার উন্মোচন করা হয়। এসময় কড়তালির মাধ্যমে সবাই সময়টি উদযাপন করেন। বিকেলের অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ থেকে আগত মাসুদ করিম।
কল্যাণী বই উৎসবে আন্তর্জাতিক বাংলা ভাষা পরিষদ এর স্টল
ভাষা ভবনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে সবাই সমবেত হন কল্যাণী বই উৎসবে। কল্যাণী পৌরসভা আয়োজিত বই উৎসবে নতুন সংগঠনের স্টল উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ থেকে আগত মাসুদ করিম। এসময় উপস্থিত ছিলেন কবি নাসির আহমেদ, জাকির হোসেন খান, সালমা আক্তার, কলকাতার ড. জয়ন্ত দাশ গুপ্ত, অনুপ বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বরুপ মৈত্র। কল্যাণীর শ্রীকৃষ্ণ ঘোষ, সামিমুল ইসলাম, জালালউদ্দিন আহমেদ। হুগলীর সুব্রত বন্ধ্যোপাধ্যায় ।
পুরো স্টলটিকে মাতিয়ে রাখেন তনুকা নন্দী, শম্পা চক্রর্বতী, সুজাতা মিত্র, শীলা সাহা, ড. সীমা রায়, বাণী চৌধুরী, দেবনিষ্ঠা জানা, জয়শ্রী টিকাদার, মৌসুমী বসু, সৌমিতা মুখার্জী এবং টিঙ্কু চট্টোপাধ্যায়।
কলকাতা শাখার সভা অনুষ্ঠিত
২৯শে নভেম্বর বিকাল ৪ টায় কফি হাউসের বই-চিত্র সভাঘরে আন্তর্জাতিক বাংলা ভাষা পরিষদ এর একটি মনোজ্ঞ আন্তর্জাতিক সভা অনুষ্ঠিত হয় । এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ থেকে ৫ জন প্রতিনিধিসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানের অনেক প্রতিনিধি ছিলেন ।
সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশের তথ্যচিত্র নির্মাতা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মাসুদ করিম । প্রধান অতিথি ছিলেন প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায় । বিশিষ্ট অতিথি ছিলেন বাংলা ভাষা আন্দোলনের অগ্রগণ্য সৈনিক নীতীশ বিশ্বাস , বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি নাসির আহমেদ এবং জাকির হোসেন খান । কলকাতা শাখার আয়োজনে এই সভায় উপস্থিত ছিলেন শিশু সাহিত্যে জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত এবং এ বছর শিশু সাহিত্যে সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার প্রাপ্ত কবি সুনির্মল চক্রবর্তী , প্রখ্যাত শিশু সাহিত্যিক আব্দুল করিম প্রমুখ । অতিথিদের পুষ্পস্তবক ও উত্তরীয় দিয়ে সম্বর্ধনা দেওয়া হয় ।
সভায় উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করেন সৌম্যা রায়চৌধুরী । তাঁর সাথে কণ্ঠ মেলান ডঃ শিল্পী গাঙ্গুলী ও বাংলাদেশের সালমা আক্তার । কথকতায় ছিলেন অনুপ বন্দ্যোপাধ্যায় ।
সভার সূচীমুখ নির্ধারণ করেন কলকাতা শাখার ডঃ জয়ন্ত দাশগুপ্ত । তিনি সমিতির পরিচালন পর্ষদের যুগ্ম সম্পাদক হিসাবে সমিতির গঠনবৃত্তান্ত , লক্ষ্য , উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেন । বাংলা ভাষা যাতে ধ্রুপদী সম্মান লাভ করে সেজন্য সমমনস্ক ব্যক্তি ও সংগঠনকে আন্দোলনে সামিল হতে আহ্বান জানান ।
সভায় দুই বাংলার প্রতিনিধিরা বক্তব্য রাখেন । প্রতুল মুখোপাধ্যায় এর সঙ্গীত পরিবেশনা উপস্থিত সদস্য ও শ্রোতাদের মাঝে এক বিশেষ মাত্রা যোগ করে।
আব্দুল করিম , সুব্রত বন্ধ্যোপাধ্যায় , আভা সরকার মণ্ডল , শঙ্কর ঘোষ প্রমুখ আবৃত্তি পরিবেশন করেন । কল্যাণীর সামিমুল ইসলাম, বাংলাদেশের জাকির হোসেন খান প্রমুখ বক্তব্য রাখেন । অনুষ্ঠানের সভাপতি মাসুদ করিম ভাষা আন্দোলনে দুই বাংলার সংঘবদ্ধতার উপর গুরুত্ব দেন । ভাষা সংক্রান্ত যে কোন আলোচনায় সকল ভাষা শহিদদের শ্রদ্ধার সাথে স্বরণ করার অনুরোধ জানান।
অনুষ্ঠানে বিরতির সময় উপস্থিত সবাইকে আপ্যায়িত করা হয় । সভাটি দুই বাংলার ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বন্ধনকে আরো সুদৃঢ় করল । অনুপ বন্দ্যোপাধ্যায় এর সঞ্চালনায় সমগ্র অনুষ্ঠানটি দর্শকগন দারুনভাকে উপভোগ করেন।
এখানে উল্লেখ্য কল্যাণী এবং কলকাতার দুটো অনুষ্ঠানেই কোন ডেলিগেশন ফি গ্রহণ করা হয়নি। স্থানীয় ভাষাপ্রেমীরা নিজেরাই যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করেন। এমনকি বাংলাদেশ এবং ভারতের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত অতিথিদের জন্য সম্পূর্ণ বিনামূল্যে হোটেলের ব্যবস্থা করা হয়। উত্তরীয়, কলম, নোটবই ছাড়াও কল্যাণীতে মেমেনটো (স্মৃতিস্মারক) প্রদান করা হয়।
Design & Developed By: RTD IT ZONE
Leave a Reply