বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:১৯ অপরাহ্ন

অদ্বিতীয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিনে অসীম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা

মাসুদ করিম
  • আপডেটের সময় : বৃহস্পতিবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০২৩
  • ২৩০ বার দর্শন
স্ক্রিপ্ট বুঝিয়ে দেয়ার পর তা নিজের মত প্রকাশ করছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

২৬ মার্চ, ২০২০। পরিচিত হলাম ‘লকডাউন’ নামে এক নতুন শব্দের সাথে। এই শব্দ আমি পূর্বে ব্যবহার করিনি বা প্রয়োজন হয়নি। পৃথিবী যে অজানা একটা শংকার মধ্যে পড়তে যাচ্ছে তা ধীরে ধীরে অনুভব করলাম। নানান ভাবে একের পর এক আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। সড়ক, নৌ, বিমান সব পথই অবরুদ্ধ। এমন পৃথিবী আমার কল্পনার জগতে কখনই লালন করিনি। পৃথিবীটা যেন নিজের কাছেই নিজে জিম্মি হয়ে পড়েছে। অদ্ভুদ এক ঘটনা যা জন্মের পর দেখিনি।

পরিচিত হলাম ‘করোনা ভাইরাস ডিজিজ’ যা সংক্ষেপে ‘কভিড১৯’ (COVID19) এবং ২০১৯ এ এর উৎপত্তি। এই মহামারি যে কতটা শক্তিশালী ও বিপদজনক তা শুরুতেই টের পাওয়া যায়নি। পৃথিবীর তাবৎ পরাশক্তিকে ধরাশায়ী করে তছনছ করে দিয়েছে এই করোনা নামক ভাইরাস। আমরা শংকিত ছিলাম আমাদের নিজেদের জীবন নিয়ে।

আমি জানতাম না একথাই হবে শেষ কথা। যদি তাই হতো তবে কথা বলতাম লাইন না কাটা অবধি।

২০২০ এর ২৯ জুন সকাল ১১টায় ফোন করি কলকাতায়। ১০০ সেকেন্ড কথা হয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সাথে। বলার চেষ্টা করি সময়টি মোটেই ভাল নয়। এ মূহূর্তে সুস্থ থাকাটা খুব জরুরী। সৌমিত্রদা যাতে স্যুটিং এ না যান। বার বার বললাম। যদিও বয়সে যারা ছোট তাদের কথা বড়রা খুব একটা আমলে নিতে চান না। মনে করা হয় এসব কথার কথা।

সৌমিত্রদা বললেন, স্যুটিং এখনও শুরু করিনি তবে জুলাই এর মাঝামাঝি থেকে একটু আধটু কাজতো করতেই হবে।

সৌমিত্রদার কথাটি আমার মোটেও পসন্দ হয়নি। মনে একটা অজানা শংকা কাজ করছিল। এই বয়সে এমন একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে থেকে দাদা স্যুটিং এ না গেলেই কি নয়? আবার ভাবলাম, দাদার জন্য আমার এই শংকাটা যেন অতিরঞ্জিত হয়ে যাচ্ছে। এতটা শংকিত না হলেও চলে।

অপরপ্রান্ত থেকে দাদা বললেন, তোমরা সাবধানে থেকো, বাড়ির সব্বাইকে আমার শুভেচ্ছা। মাত্র ১০০ সেকেন্ডের কথা। সেদিনের পর সৌমিত্রদার সাথে আমার আর কথা হয়নি। জুলাই আগস্ট পেরিয়ে সেপ্টেম্বর। অনেকদিন দাদার কন্ঠ শুনি না। ফোন করলে নাম বলার আগেই অপর প্রান্ত থেকে বলতেন, বলো মাসুদ খবর কি?

কলকাতায় ফোন করলেই আমার কনিষ্ঠ কন্যা আনানের কথা জানতে চাইতেন। ছবিটি গল্ফগ্রীণে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে ২০১৫ এর ২৯ এপ্রিল তোলা। – ছবি সালমা আক্তার লিজু

১৯৫৮-র ৯ আগস্ট, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে একটি স্মরণীয়দিন, সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে সৌমিত্র এদিন প্রথম ক্যামেরার মুখোমুখি হলেন। তাঁর প্রথম ছবি, সত্যজিৎ রায়ের পঞ্চম। তারপর এই দুই দীর্ঘাদেহী পুরুষ, সত্যজিৎ ও সৌমিত্র, দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে বাংলা চলচ্চিত্রকে নান্দনিক সাফল্যের এক চূড়া থেকে আরেক চূড়ায় নিয়ে গেছেন। সত্যজিৎ রায়ের চৌদ্দটি ছবির নায়ক ছিলেন সৌমিত্র। আমার প্রতিটি ছবির স্ক্রিপ্ট আমি সৌমিত্রকে দেখাতাম। তাই একদা এক অনুষ্ঠানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে কিছু বলতে গিয়ে সত্যজিৎ রায় বলেন, ওর প্রতি আমার নির্ভরশীলতা শিল্পী জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত থাকবে”। 

সত্যজিৎ রায়ের চারুলতা ছবির একটি দৃশ্য এখনও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনে স্মৃতির মাঝে অন্যতম হয়ে আছে। ছবির শেষ দৃশ্যটি সত্যজিৎ এমনভাবে সাজিয়ে ছিলেন যে, চারু ও ধ্রুপদী একে অন্যের হাত ধরে ঘরের ভেতর প্রবেশ করে। কিন্তু এই দৃশ্যটি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে একদম পসন্দ হয়নি। তাই আমি মানিকদাকে (সত্যজিৎ রায় এর ডাকনাম) বললাম,“এই দৃশ্যটি আমার একদম পসন্দ হয়নি। কেননা ধ্রুপদীর যখন বোধদয় হলো যে তার স্ত্রীর সঙ্গে অমলের একটা সম্পর্ক গড়ে উঠে, তারপরতো সে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায় এবং এক পর্যায়ে আবার ফিরেও আসে। কিন্তু যখন ফিরে আসে তখন চারু তাকে ডাকলো ঘরে প্রবেশ করার জন্য। সেখানে খুব ছোট দু’তিনটি সংলাপ ছিল। চারু তাকে বললো, এসো, ঘরে এসো। তখন ধ্রুপদীর তাকে বলেছিল, এ ঘর কি আর সে ঘর আছে? তখন হাতটা বাড়িয়ে ঘরে চলে যায়”।

কিন্তু  এদৃশ্য আমার একদম পসন্দ হয়নি। কেননা রবীন্দ্রনাথের চারু বললো, না থাক। সেটা এমন  মর্মান্তিক যেন বুকে একটা শেল বিধিয়ে দেয়, যেন দুঃখ-বেদনা-যন্ত্রণার এক বহিঃপ্রকাশ। আমি মানিকদাকে বললাম, “এদৃশ্য আমার একদম পসন্দ হয়নি। মানিকদা বললেন, কেন?এছাড়া আর কি হতে পারতো? কারণ তখনতো ডিভোর্স ছিল না, তাদেরতো একসাথে বাস করতে হতো”।

আমি বললাম, হ্যাঁ, সেটা হয়তো লোজিক্যালী ঠিক কিন্তু আরো অন্যকিছু লোজিকও বোধহয় আছে। আমার এদৃশ্যটি ভাল লাগছে না। এরপর সেদিন আমি কাজ শেষে বাড়ি চলে যাই।

পরদিন সকালে যখন স্যুটিং এ এলাম তখন শিশুর মত উৎসাহ নিয়ে মানিকদা আমাকে বললেন, শোন, কাল রাতে আমি ওটা পাল্টিয়েছি।

আমি জানতে চাইলাম, কি করেছেন মানিকদা?

তখন তিনি নতুন এন্ডিংটা আমাকে শোনালেন। বললেন, হাত দু’টো এগিয়ে আসছে- একে অন্যের দিকে, চারদিকে সবকিছু পাথরের মত স্তব্ধ, পৃথিবীতে আর কিছুই নড়ছেনা। এমনকি বাড়ির চাকরটা বাতি নিয়ে আসছে। নিরবতা গভীর হচ্ছে। এই যে দূরত্ব, আর কোনদিন সে স্পর্শ করছে না।

এই চির দূরত্বটাকে বিদ্যমান কাঠামোতে ফুটিয়ে তোলার কারণেই `চারুলতা’ দর্শক হৃদয়ে স্থায়ীভাবে দাগ কেটেছে। – সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এর জীবন ও কর্মভিত্তিক তথ্যচিত্র `কৃষ্ণকলি`র চুম্বক অংশ।  

“এটা সত্য যে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে সত্যজিৎ রায় গড়ে তুলেছেন। আবার এটাও সত্য যে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও সত্যজিৎ রায়কে প্রকাশিত হতে সাহায্য করেছেন।

আজ ১৯ জানুয়ারি। বেঁচে থাকলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বয়স হতো আটাশি।  অদ্বিতীয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিনে অসীম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।

এই পোস্টটি আপনার সামাজিক মিডিয়াতে শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও খবর

Address

Registered Office: 44/1 North Dhanmondi (5th Floor) Kalabagan, Dhaka- 1205, Bangladesh Email: kalabaganbarta@gmail.com / admin@kalabaganbarta.com Telephone: +88-02-58154100 Editorial Office: Karim Tower 44/7-A&B, West Panthapath, Kalabagan, Dhaka-1205

Correspondences

USA: Mainul Haq (Atlanta) Kolkata: Sunirmal Chakraborty Mobile: +91-8017854521 Ashim Kumar Ghosh Address: 3D K.P Roy Lane, Tollygunge Phari Kolkata- 700 033, WB, India Mobile: +91-9874891187                                                                                                           S. M. Ashikur Rahman (Technical Adviser)
Author: Masud Karim © All rights reserved 2020. Kalabaganbarta

Design & Developed By: RTD IT ZONE