গত ৫ আগস্ট ছাত্র আন্দোলনে গুলিতে নিজের স্বামীকে ‘নিহত’ দেখিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৩০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা সেই নারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গতকাল বৃহস্পতিবার তাঁকে কক্সবাজার থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় এ ঘটনায় জড়িত শফিকুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তিকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আজ শুক্রবার (২২ নভেম্বর) ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি গ্রহণের জন্য গ্রেপ্তার কুলসুম আক্তারকে ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে পাঠানো হয়েছে।
এর আগে ঢাকা থেকে রুহুল আমিন গুলজার নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁকে গ্রেপ্তারের সূত্র ধরেই পরে শফিকুল ও কুলসুমকে গ্রেপ্তার করা হয়।
রুহুল আমিন ও শফিকুলকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করছে। রুহল আমিনের বাড়ি মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার ফুলহারা গ্রামে। তিনি ঢাকার আশুলিয়ার জামগড়া এলাকায় থাকেন। শফিকুল ইসলামের বাড়ি মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার টেপড়া গ্রামে। তাঁরা একে অপরের পূর্ব পরিচিত।
স্বামীকে ‘নিহত’ দেখিয়ে দায়ের করা সেই মামলায় কুলসুম নিজেকে রুহুল আমিনের জামগড়ার বাড়ির ভাড়াটিয়া হিসেবে উল্লেখ করেন। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিজয় মিছিল চলাকালে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের গুলিতে স্বামী আল-আমিন মিয়া (৩৪) নিহত হয়েছেন বলে উল্লেখ করে গত ২৪ অক্টোবর কুলসুম ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটি করেন। পরে ৮ নভেম্বর তা আশুলিয়া থানায় এজাহারভুক্ত করা হয়।
মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খান, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুছ ছালাম, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, সাবেক ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমানসহ ১৩০ জনের নাম উল্লেখ করা হয়।
গত ১২ নভেম্বর সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানায় গিয়ে হাজির হন কুলসুম আক্তারের স্বামী আল-আমিন মিয়া। তাঁকে ‘নিহত’ দেখিয়ে মিথ্যা মামলা করে মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। পুলিশকে তিনি বলেন, স্ত্রী কুলসুমকে নিয়ে তিনি দক্ষিণ সুরমা থানা এলাকায় থাকেন। গত ৫ আগস্ট কুলসুম তাঁর সঙ্গে সিলেটেই ছিলেন। এর কয়েক দিন পরে তাঁর সঙ্গে ঝগড়া করে কুলসুম মানিকগঞ্জ ঘিওরে তাঁর (কুলসুম) বাবার বাড়িতে চলে যান। এর পর তিনি জানতে পারেন, তাঁর স্ত্রী তাঁকে ‘নিহত’ দেখিয়ে মামলা করেছেন।
কুলসুম আক্তার বলেন, ‘সিলেট থেকে আসার পর আমি চাকরি খোঁজার জন্য ঢাকায় গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ফেরার পথে বাসে শফিকুল ইসলামের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তিনি চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে আমার মোবাইল নম্বর নেন। এর কয়েক দিন পরে চাকরির ব্যবস্থা হয়েছে জানিয়ে শফিকুল আমাকে আইডি কার্ড (জাতীয় পরিচয়পত্র) নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন। আমি শফিকুলের সঙ্গে দেখা করলে শফিকুল ও রুহুল আমিন আমাকে মামলা করতে বলেন। মামলা করলে ৫ লাখ টাকা পাওয়া যাবে এবং প্রতি মাসে ২০ হাজার করে টাকা ভাতা পাওয়া যাবে বলে জানান। আর মামলা না করলে আমার জেল ও ফাঁসি হবে বলে ভয় দেখান তাঁরা। এভাবে ব্ল্যাকমেল করে রুহুল আমিন ও শফিকুল আমাকে মামলা করতে বাধ্য করেছেন।’
কুলসুম আরও বলেন, ‘মিথ্যা মামলার বিষয়টি ফাঁস হওয়ার পর রুহুল আমিন ও শফিকুল আমাকে কক্সবাজার নিয়ে একটি ঘরে আটকে রাখেন। তাঁরা আমার মোবাইল নিয়ে নেন। এ সময় তাঁরা আমাকে ৩-৪ জনকে দিয়ে ধর্ষণ করিয়ে বিচে ফেলে রাখার প্ল্যান করেন। উদ্ধার হওয়ার পর যাতে আমি বলি মামলার আসামিরা আমাকে ধর্ষণ করেছেন। আমি তাতে রাজি না হলে আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কয়েক দিন পরে নানা ভয়ভীতির মুখে আবার আমাকে কক্সবাজার যেতে বাধ্য করা হয়। তাঁরা আমাকে মেরে ফেলার প্ল্যান করেছিলেন।’
কুলসুমের বোন ফাতেমা বেগম বলেন, ‘আমার বোন কোনো দিন আশুলিয়া থাকেনি। রুহুল আমিনকে চিনতোই না। ওর স্বামীর সঙ্গে সিলেট থাকত। গত ৫ আগস্ট আমার বোন ওর স্বামীর সঙ্গে সিলেটেই ছিল। মিথ্যা মামলার ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর রুহুল আমিন আমার বোনকে কক্সবাজার নিয়ে যায়। এর পর থেকে আমার বোনো রুহুল আমিনের হেফাজতেই ছিল। তাঁর হেফাজত থেকেই পুলিশ আমার বোনকে আটক করে।’
আশুলিয়ার ব্যবসায়ী লিয়াকত আলী সরকার বলেন, ‘কুলসুমের মামলায় আমি ৫৭ নম্বর আসামি। হত্যা মামলায় আসামি হওয়ার বিষয়টি জানার পর আমি রুহুল আমিনের ছেলে কাউসারের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি আমাকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সমন্বয়ক হিসেবে পরিচয় দেন। এর পরে মামলা থেকে নাম কাটানোর জন্য টাকা দাবি করেন। আমি প্রথমে তাঁকে ৫০ হাজার টাকা দেই। পরে আরও ২০ হাজার টাকা দেই। আমার মতো আরও ২৫ জনে মিলে তাঁকে ২৭ থেকে ২৮ লাখ টাকা দিয়েছেন।’
আশুলিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. রকিবুল হোসেন বলেন, ‘প্রথমে ঢাকা থেকে রুহুল আমিনকে আটক করা হয়। পরে তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী গতকাল বৃহস্পতিবার কক্সবাজার থেকে শফিকুল ও কুলসুমকে আটক করা হয়।’
আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর সিদ্দীক বলেন, ‘কুলসুমকে আটক করা হয়েছে। ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি গ্রহণের জন্য তাঁকে আজ শুক্রবার ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে পাঠানো হয়েছে। রুহুল আমিন ও শফিককে পুলিশ হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।’
পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় রুহুল আমিন ও শফিকুল সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমাকে ফাঁসানোর জন্য কুলসুম এসব অভিযোগ করছেন।’ সূত্র : আজকের পত্রিকা, আমাদের সময়।
Design & Developed By: RTD IT ZONE
Leave a Reply