রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ০৯:৫৬ অপরাহ্ন

একটি জীবন্ত প্রতিভার মৃত্যু: তীরন্দাজিতে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করে আজ চায়ের দোকান চালায় দীপ্তি

অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেটের সময় : শনিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৪
  • ৫৬ বার দর্শন

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সেই দৃশ্য–*_  অভিমন্যু একা চক্রব্যূহ ভেদ করে ঢুকে পড়েছেন আর কৌরবপক্ষের ১৪ মহারথী এবং ৫ অক্ষৌহিনী সৈন্য সেই বালককে ঘিরে ফেলেছে কিন্তু সেই বালক-বীরের তেজের সামনে কৌরবপক্ষের বড় বড় মহারথীরাও দাঁড়াতে পারছেন না। কৃপ, দ্রোণ, কর্ণ, শল্য, দুঃশাসন, অশ্বত্থামা, শকুনি– সবাই তার কাছে পরাজিত। কৌরব সৈন্যরা অভিমন্যুর বাণে কচুকাটা হয়ে যাচ্ছে। দুর্যোধন তা দেখে বললেন, “আজ এই বালক তো একাই পুরো কৌরব সৈন্যকে মেরে শেষ করবে, আপনারা কিছু করুন !”

‎দ্রোণ বললেন, “যতক্ষণ এই বীরের হাতে ধনুক আছে ততক্ষণ একে হারানো অসম্ভব !  আগে এর হাতের ধনুক কাটো !” দেখতে দেখতে ১৪ মহারথীর সম্মিলিত আক্রমণে বালক অভিমন্যুর হাতের ধনুক কাটা গেল। চক্রব্যূহে একলা ধনুর্ধরের হাতে ধনুক না-থাকলে তার ঠিক কতটা অসহায় লাগে, সেটা ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন তীরন্দাজ, ঝাড়খণ্ডের দীপ্তি কুমারীকে জিগ্যেস করুন !

‎ঝাড়খণ্ডের হতদরিদ্র আদিবাসী পরিবারের এই কন্যাটির বাবা-মা দু’জনেই দিনমজুর। মাত্র চোদ্দ বছর বয়েসে, বাবার বানিয়ে দেওয়া বাঁশের ধনুক নিয়েই দীপ্তি স্কুল লেভেলের আর্চারিতে চ্যাম্পিয়ন। বাঁশের ধনুক নিয়েই স্কুল লেভেল থেকে স্টেট লেভেলের যাত্রাপথে তার সংগ্রহ আরও ৬৬টি মেডেল। কিন্তু স্টেট লেভেলে বাঁশের ধনুক চলে না। দিনমজুর মা, দেড় লক্ষ টাকা ধার করে তাকে প্রতিযোগিতার উপযুক্ত একটি আধুনিক ধনুক কিনে দেন। সেই ধনুক দিয়েই স্টেট লেভেল থেকে রেকর্ড সময়ে জাতীয় লেভেলে পৌঁছে যায় দীপ্তি, সংগ্রহ করে আরো প্রায় ৪০টি মেডেল  – কোনো ব্যক্তিগত কোচের সাহায্য ছাড়াই !

‎আরো ভালো প্রশিক্ষণের জন্য দীপ্তি ডাক পায় ঝাড়খণ্ডের বিরসা মুন্ডা আর্চারি অ্যাকাডেমিতে। দীপ্তিকে আর থামানো যায়নি। বাঁশের ধনুক ছেড়ে, আধুনিক ধনুক ধরার মাত্র দু’বছরের মধ্যে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের প্রতিযোগিতায় দীপ্তি হারিয়ে দেয় জুনিয়র ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন কামালিকা বারিকে। জিতে নেয় ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নের সোনার মেডেল।

‎এবার লক্ষ্য আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা কিন্তু তার জন্য দরকার আন্তর্জাতিক মানের ধনুক। সে ধনুক কেনার ক্ষমতা দীপ্তির নেই। দীপ্তির মা এবার ধার করেন সাড়ে চার লক্ষ টাকা। ঘটি-বাটি বন্ধক দিয়ে এবং ধার করা টাকা দিয়ে দীপ্তি হাতে পায় প্রথম আন্তর্জাতিক মানের ধনুক এবং জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হবার দরুন আমন্ত্রিত হয় আমেরিকার একটি তীরন্দাজি প্রতিযোগিতায়। কিন্তু বিধি বাম। সেই প্রতিযোগিতার মাঝপথে দীপ্তির নতুন ধনুকটি ভেঙে যায়। ধনুকহীন দীপ্তিকে বাকি প্রতিযোগিতাটির সাইডলাইনেই বসে থাকতে হয়।

‎আমেরিকা থেকে দেশে ফিরে এসে দীপ্তি দ্যাখে, মা কঠিন অসুখে হাসপাতালে ভর্তি। মাথার উপর আগেই অনেক ধার। তার উপর মায়ের চিকিৎসার জন্য চড়া সুদে আরো টাকা ধার করতে হয়। বাবার সামান্য রোজগার। দাদা রিক্সাচালক। মাত্র ৬ মাসে পুরো পরিবারটি ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ে। ধনুর্ধরের হাতে ধনুক নেই, সামনে আগ্রাসী ঋণের চক্রব্যূহ। কুরুক্ষেত্রে অভিমন্যু কী করেছিলেন ?  হাতের ধনুক কাটা যাবার পরেও তিনি যুদ্ধ ছাড়েননি। শুধু তলোয়ার নিয়ে রথ থেকে মাটিতে নেমে পড়েছিলেন। সারথি সুমিত্র তাঁকে বাধা দিতে গেলে অভিমন্যু বলেছিলেন, “দেবরাজ ইন্দ্র স্বয়ং বজ্র হাতে এলেও আমি শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করবো !”

‎তীরন্দাজ হিসেবে সেই শেষ যুদ্ধটাই করছেন দীপ্তি। বাঁচার লড়াইয়ে টিকে থাকার জন্য ৬০ হাজার টাকা ধার করে একটি চায়ের দোকান খুলেছেন। এক স্থানীয় পত্রিকার জার্নালিস্ট সেই দোকানে চা খেতে এসে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন দীপ্তিকে আবিষ্কার করে অবাক হয়ে যান। দীপ্তি তাঁর পা জড়িয়ে ধরে বলেন, “স্যার, সহানুভূতি চাই না। শুধু একটা প্রতিযোগিতার উপযুক্ত ধনুক জোগাড় করে দিন। কথা দিচ্ছি জান-প্রাণ লড়িয়ে দেবো। জাতীয় চ্যাম্পিয়নের মেডেলটা আবার জিতবই !  তারপর ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ, অলিম্পিক – দেশকে মেডেল এনে দেবই ! চাই শুধু একটা ধনুক। একটু দেখুন না, স্যার। যদি কিছু করা যায়।” সাংবাদিক ভদ্রলোক তাঁর সাধ্যমতো সরকারি, বেসরকারি আর্থিক সাহায্যের জন্য চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তেমন কোনো সাহায্যই জোগাড় করতে পারেননি।‎        

অভিমন্যু যেদিন চক্রব্যূহে প্রবেশ করেন, সেদিন যুদ্ধ শুরুর আগে শ্রীকৃষ্ণকে প্রণাম করার সময় শ্রীকৃষ্ণ তাকে ‘যশস্বী ভব’ বলে আশীর্বাদ করেছিলেন। তা শুনে, অভিমন্যুর মা সুভদ্রা জিগ্যেস করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ ‘বিজয়ী ভব’ বলে আশীর্বাদ করলেন না কেন ? শ্রীকৃষ্ণ উত্তরে বলেছিলেন: “সব যোদ্ধার কপালে বিজয় লেখা থাকে না কিন্তু তাঁদের বীরত্ব এবং তাঁদের লড়াইটা মহাকাল চিরদিন মনে রাখে”।

‎চরম আর্থিক দুরবস্থায়, সামান্য একটি চায়ের দোকানকে সম্বল করে, ঋণের চক্রব্যূহে দাঁড়িয়ে, ধনুকহীন একা এক ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন আদিবাসী-কন্যার এই লড়াইটাও হয়তো ভারতীয় তীরন্দাজির ইতিহাসে সেভাবেই লেখা থাকবে ! 

আশ্চর্য লাগে এটা দেখে যে, *অনুরাগ ঠাকুর-মিনিস্টার অফ ইউথ আ্যফেয়ার্স & স্পোর্ট্স এবং নিতীশ প্রামাণিক-মিনিস্টার অফ স্টেট ফর ইউথ আ্যফেয়ার্স & স্পোর্ট্স এই গরিব ভারতীয় তীরন্দাজের জীবনযুদ্ধে এখনও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারেননি !  হাত বাড়ায়নি কোটি পতি ক্রিকেটার ও বলিউড স্টারস, হাত বাড়ায়নি ঝাড়খণ্ডের সরকার, হাত বাড়ায়নি দেশের কোন শিল্প পতি।

আমাদের দেশের এমন অনেক প্রতিভা হারিয়ে যায় শুধু দারিদ্রের অন্ধকারে। একজন খেলোয়াড় দেশের প্রতিনিধিত্ব করে জিতলে যদি তার জয় আর দেশের জয় এক হয়। তাহলে তার জীবনের লড়াইয়ে হেরে যাওয়া কি দেশের হেরে যাওয়া নয়? আবার কোনোদিন দীপ্তি জিতে গেলে তার জয়ের ভাগ গোটা দেশ নেবে, কিন্তু তার লড়াইয়ের ভাগ কেউ নেয়নি। এখন লড়াইয়ের ময়দানে দীপ্তি একা।

এভাবে নিভে যাবে একটি মশাল?

সূত্র : ইন্টারনেট

এই পোস্টটি আপনার সামাজিক মিডিয়াতে শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও খবর

Address

Registered Office: 44/1 North Dhanmondi (5th Floor) Kalabagan, Dhaka- 1205, Bangladesh Email: kalabaganbarta@gmail.com / admin@kalabaganbarta.com Telephone: +88-02-58154100 Editorial Office: Karim Tower 44/7-A&B, West Panthapath, Kalabagan, Dhaka-1205

Correspondences

USA: Mainul Haq (Atlanta) Kolkata: Sunirmal Chakraborty Mobile: +91-8017854521 Ashim Kumar Ghosh Address: 3D K.P Roy Lane, Tollygunge Phari Kolkata- 700 033, WB, India Mobile: +91-9874891187                                                                                                           S. M. Ashikur Rahman (Technical Adviser)
Author: Masud Karim © All rights reserved 2020. Kalabaganbarta

Design & Developed By: RTD IT ZONE